আল্লাহর এক অশেষ নেয়ামত লবণ

সাঈদ কাদির

লবণ আল্লাহ প্রদত্ত একটি বিশেষ নেয়ামত। যে কোনো খাবার সুস্বাদু হওয়ার অনেকাংশে নির্ভর করে লবণের ওপর। এটি খাদ্যে ব্যবহৃত এক ধরনের দানাদার পদার্থ। লবণ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। লবণের স্বাদকে মৌলিক স্বাদের একটি বলে গণ্য করা হয়। এটি পৃথিবীর সর্বত্র খাদ্য প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও লবণ প্রাচীনকাল থেকেই মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি সংরক্ষণের জন্য প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

লবণ একটি পানিগ্রাহী পদার্থ। এটি একটি খনিজদ্রব্যও। বৈজ্ঞানিক নাম Sodium Chloride। দেখতে দানাদার। বর্ণ সাদাটে। খাদ্য প্রস্তুতির একটি অপরিহার্য উপাদান। লবণের স্বাদ না থাকলে কোনো খাবারই খাওয়ার উপযুক্ত হয় না। মানুষের খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের লবণ ব্যবহার করা হয়। যেমন- অপরিশোধিত সৈন্ধব লবণ (sea salt), পরিশোধিত খাবার লবণ, আয়োডিনযুক্ত লবণ, বিট লবণ বা সুলেমানি লবণ (এক ধরনের সোডিয়াম সালফেটসমৃদ্ধ খনিজ লবণ) ইত্যাদি।

সমুদ্রের পানি অথবা খনি থেকে লবণ আহরণ করা হয়। সমুদ্রের লোনা পানি ফুটিয়ে বাষ্পীভূত করে লবণ উৎপাদন করা হয়। এছাড়া লবণাক্ত কূপ অথবা লবণাক্ত হ্রদের পানি থেকেও লবণ আহরণ করা হয়ে থাকে। লোনা পানির পাশাপাশি পাথুরে খনি থেকেও লবণ আহরণ করা হয়। প্রকৃতিতে অপরিশোধিত লবণ পাওয়া যায়, যেমন- সমুদ্রের পানি। রিফাইন বা পরিশোধন করে যে উপাদান পাওয়া যায়, তাকে আমরা বলি খাবার লবণ। আর ইংরেজিতে একে বলে টেবিল সল্ট। এর সঙ্গে আয়োডিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় আয়োডাইড সল্ট বা আয়োডিন লবণ। ২০০২ সালে বিশ্বে মোট ২১০ মিলিয়ন টন লবণ উৎপাদন করা হয়। শীর্ষ ৫ উৎপাদক রাষ্ট্র হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (৪০.৩ মিলিয়ন টন), চীন (৩২.৯), জার্মানি (১৭.৭), ভারত (১৪.৫) এবং কানাডা (১২.৩)। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে লবণের খনি আছে।

লবণ না হলে আমরা খাদ্য খেতে পারি না। লবণ শরীরের জন্য খুব দরকারি একটি উপাদান। প্রত্যেক খাদ্যেই লবণ দিতে হয়। লবণ শুধু মানুষেরই নয়, সব প্রাণীর দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সর্বোপরি লবণ ছাড়া খাবারের কথা ভাবাই যায় না। মানুষ খাবারের মধ্যে লবণ মিশিয়ে শরীরের প্রয়োজনীয় লবণ গ্রহণ করে। প্রাণীও শরীরের প্রয়োজনীয় লবণ নিজের খাবার থেকে জোগাড় করে নেয়। খাবারে লবণ না দিলে কোনো খাবারই সুস্বাদু হয় না। সরাসরি খাদ্য ছাড়াও মানুষ নানাভাবে লবণ গ্রহণ করেন। পানি, শাকসবজি, ফলমূল থেকেও পর্যাপ্ত লবণ গ্রহণ করেন মানুষ। কিন্তু লবণ শুধু খাবারের স্বাদ ও গুণই বাড়ায় না। আরও অনেক কাজে লাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই জিনিসটি।

শাকসবজি ধোয়া, কৃত্রিম ফুল ও পাতা পরিষ্কার, ফল ও সবজির দাগ দূর করা, তামা, পিতল, রুপা ইত্যাদি ধাতু পরিষ্কার, কাঠ পরিষ্কার, আসবাবপত্র পরিষ্কার, পিঁপড়া দূর করা, গাছের আগাছা দূর করা, দুধ ভালো রাখা, দুর্গন্ধ দূর করা, জুতো, শৌচাগার, ঘরের তাকের পুরনো বা বাসি গন্ধ দূর করা ও দাঁত শক্ত করার কাজেও লবণ প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।

লবণ খুব ভালো প্রিজারভেটিভও। অর্থাৎ লবণ দিয়ে অনেকদিন খাবার সংরক্ষণ করা যায়। খাবার বা কোনোকিছু অনেকদিন ঠিক রাখার জন্য তাতে লবণ মাখিয়ে নিলে সেটি অনেকদিন টিকে থাকে। তাতে সহজে পচন ধরে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লবণ শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তত্ত্বাবধানে লবণ শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটছে। যার ধারাবাহিকতায় উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান এবং দেশে লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বিসিক ১৯৬০ সাল থেকে কঙ্বাজার এলাকায় কাজ করে আসছে।

লবণ শিল্প দেশের সর্ববৃহৎ শ্রম নিবিড় কুটির শিল্প। লবণ উৎপাদন থেকে মিল পর্যায়ে প্যাকেটজাত হওয়া পর্যন্ত এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৫ লাখ লোক জড়িত এবং প্রায় ২৫ লাখ লোক নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে এ শিল্প প্রতি বছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার অবদান রাখে, যা ফিনিস গুডস হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ইপসিক বর্তমান বিসিক সর্বপ্রথম উপকূলীয় অঞ্চলের মাত্র ৬ হাজার একর জমি নিয়ে সৌর পদ্ধতিতে লবণ শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে, যা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়ে ২০১৪-২০১৫ লবণ মৌসুমে লবণ চাষে আনীত জমির পরিমাণ ৫১ হাজার ৯৭০ একর।

লবণের মূল উৎস হলো সমুদ্রের পানি। সমুদ্রের পানির থেকেই যে লবণ উৎপাদিত হয়, এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ইঙ্গিত করেছেন। এরশাদ হয়েছে, 'তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, এটি মিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও এটি লবণাক্ত, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।' (সূরা ফোরকান : ৫৩)।

হাদিসেও লবণের বর্ণনা এসেছে। কখনও লবণের ঔষধি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। কখনও উদাহরণ পেশ করার জন্য হাদিসে লবণের আলোচনা এসেছে। এক হাদিসে এরশাদ হয়েছে, সা'দ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে কেউ মদিনাবাসীর ওপর আগ্রাসী হয়ে আসবে সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যেমনিভাবে লবণ পানিতে মিশলে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।' (বোখারি : ১৮৭৭)।

অপর এক হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) তাঁর অন্তিম অসুস্থতার সময় একদিন বের হলেন, মিম্বরের ওপরে গিয়ে বসলেন, আল্লাহ তায়ালার হামদ ও সানা বর্ণনা করলেন, অতঃপর বললেন, একসময় এমন আসবে, যখন মানুষ অধিক হবে, অথচ দ্বীনের সাহায্যকারী হ্রাস পেয়ে এত পরিমাণ হবে, খাবারের মধ্যে লবণ যত পরিমাণ থাকে।' (বোখারি : ৩৬২৮)। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.