তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব

তাহাজ্জুদ আরবি শব্দ। অর্থ হলো- নিশীথে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। 'হাজাদা' মূল ধাতু থেকে, এর মানে হলো- 'নিদ্রা যাওয়া' এবং 'হাজ্জাদা' ক্রিয়ামূল থেকে এর অর্থ হলো- 'নিদ্রা ভঙ্গ হওয়া'। তাই তাহাজ্জুদের সঙ্গে নিদ্রা ও জাগরণের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় ফকিহরা বলেন, এশার নামাজান্তে ঘুমানোর পর জাগ্রত হয়ে এ নামাজ পড়তে হয়। (লিসানুল আরব)। কেউ কেউ 'জুহদ' শব্দের সঙ্গে 'তাহাজ্জুদ' এর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করেন; যার অর্থ হলো- শক্তি ও ক্লেশ। কারণ এ নামাজে কষ্ট-ক্লেশ হয় এবং এর জন্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয় বা এর দ্বারা আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ হয়। মূলত এটি শব্দগত সম্পর্ক নয়; বরং অন্তর্নিহিত সম্পর্ক।

মধ্যরাতের পর বা রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শুরু হয়। ঘড়ি ঘণ্টা হিসাবে রাত ২টার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার (সূর্যোদয়ের দেড় ঘণ্টা) আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত। সাহরির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জামানায় তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য আলাদা আজান দেয়া হতো। এখনও মক্কা ও মদিনা শরিফে এ নিয়ম প্রচলিত আছে। তাহাজ্জুদ একাকী পড়াই উত্তম; জামাতে পড়া অনেক মুজতাহিদ ফকিহ মাকরুহ বলেছেন। তাই অন্য সব সুন্নত ও নফল নামাজের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের কেরাতও সিররি; অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজের সূরা-কেরাত নিম্নস্বরে পড়তে হয় এবং এর জন্য একামতেরও প্রয়োজন হয় না।

 নফল ইবাদত বিশেষ উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ছাড়া গোপনে করাই বাঞ্ছনীয়। তবে 'তাহাজ্জুদ নামাজ অন্ধকারে পড়তে হয়' বা 'তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে জিন আসে' অথবা 'তাহাজ্জুদ নামাজ শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়' এসব ভুল ধারণা। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচার মানসিকতা যেন না থাকে; এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।

 নফল নামাজ এক সালামে তথা এক নিয়তে দুই, চার, ছয় ও আট রাকাত বা আরও বেশি পড়া যায়। তবে দিনের বেলায় এক নিয়তে চার রাকাত ও রাতের বেলায় এক নিয়তে আট রাকাতের অধিক না পড়াই উত্তম; আর দুই রাকাত করে আদায় করা সর্বোত্তম।

 তাহাজ্জুদ নামাজের কেরাত হলো সবচেয়ে দীর্ঘ। এ নামাজে যত ইচ্ছা তত দীর্ঘ কেরাত পাঠ করা যায়। এতে রাকাত দীর্ঘ করার জন্য এবং তেলাওয়াতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য একই রাকাতে বিভিন্ন সূরা ও বিভিন্ন আয়াত পড়া যায় এবং একই রাকাতে একই সূরা বারবার পড়া যায়। নফল নামাজে কেরাতে তেলাওয়াতের তারতিব বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি নয়। নফল নামাজে রুকু, সেজদাসহ প্রতিটি রুকন বা পর্ব দীর্ঘাতিদীর্ঘ করা সুন্নত ও মুস্তাহাব। এজন্য রুকু ও সেজদায় তাসবি অনেকবার পড়া যায় এবং অন্যান্য পর্বে বেশি পরিমাণে বিভিন্ন দোয়া মাসুরা (যা কোরআন হাদিসে আছে) পাঠ করা যায়।

তাহাজ্জুদ নামাজ নবী করিম (সা.) সবসময় পড়তেন। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.) কে উদ্দেশ করে বলেন, 'এবং রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে (মাকামে মাহমুদে)।' (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯)। 

তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত; অতিরিক্ত হিসেবে একে নফলও বলা হয়। এ নামাজ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য ছিল। এর রাকাত সংখ্যা আট, ১২ থেকে ২০ পর্যন্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। চার রাকাত বা দুই রাকাত পড়লেও তা তাহাজ্জুদ হিসেবে পরিগণিত হবে। একে 'সালাতুল লাইল' বা 'কিয়ামুল লাইল' নামাজও বলা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোকৃষ্ট আমল। আলী (রা.) বলেছেন, 'ওয়া মান তলাআল উলা ছাহারাল লায়ালি'। অর্থাৎ 'যারাই ইবাদতে আধ্যাত্ম জগতে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ঊর্ধ্বারোহণ করেছেন; তারাই রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছেন।' [দিওয়ানে আলী (রা.), নাহজুল বালাগা]। তাই তাহাজ্জুদ হলো মোক্ষ লাভের মোক্ষম মাধ্যম।

 তাহাজ্জুদ নামাজের আগে ও পরে কোরআন তেলাওয়াত করা যারপরনাই উপকারী আমল। এ সময় সূরা মুজ্জাম্মিল, মুদ্দাছির, মুলক, ওয়াকিআহ, দুখান, আর রহমান, ইয়াসিন, হাশর ও সূরা কাহাফ এবং অন্যান্য সূরা তেলাওয়াত করা অত্যন্ত বরকতময়। এটি দোয়া কবুলের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দার ফরিয়াদ শোনেন। তরিকত জগতে তাহাজ্জুদ অনন্য পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.